‘যাওয়ার সময় পাওয়ো আইঞ্জা করি ধরিয়া কইছইন আমি যাইয়ার দেশর লাগি শহীদ অইতাম’
শনিবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৫৮ PM

জুলাই অভ্যুত্থানে গোলাপগঞ্জে শহীদ গৌছের মা লেবু বেগম

‘যাওয়ার সময় পাওয়ো আইঞ্জা করি ধরিয়া কইছইন আমি যাইয়ার দেশর লাগি শহীদ অইতাম’

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১২/০৭/২০২৫ ১০:০৩:৫২ AM

‘যাওয়ার সময় পাওয়ো আইঞ্জা করি ধরিয়া কইছইন আমি যাইয়ার দেশর লাগি শহীদ অইতাম’


‘যাওয়ার সময় পাওয়ো আইঞ্জা করি ধরছইন, কইছইন আমি যাইয়ার দেশর লাগি শহীদ অইতাম, তুমি বাদা-নিষেধ দিও না। দোয়া করিও আল্লায় বাচাইতা, আমার ভাগ্না-ভাগ্নি হকল যাইরা, আমি যাইতাম না কিলা।‌‌‌’

গত বছরের ৪ আগস্ট জুলাই অভ্যুত্থানের শেষ সময়ের উত্তাল মুহূর্তে সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলায় পুলিশ-বিজিবির গুলিতে নিহত গৌছ উদ্দিনের সত্তরোর্ধ বয়সী মা লেবু বেগমের মনে এখনো দগদগে স্মৃতি তার ছেলের শেষ কথাগুলো। ছেলের ব্যবহৃত ঘরের বিছানা ও জিনিসপত্র আজও আঁকড়ে ধরে রেখেছেন তিনি।

৩২ বছর বয়সী গৌছ উদ্দিন পেশায় ছিলেন সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালক। জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদের মর্যাদা পেয়েছেন। ব্যক্তি জীবনে অবিবাহিত গৌছ উদ্দিন চার ভাই ও এক বোনের সংসারে চতুর্থ। বাবা ও সবার বড় ভাই মারা গেছেন আগেই। একমাত্র বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় তিন ছেলেকে নিয়েই ছিল মায়ের সংসার। গৌছের বড় ভাই আবুল কালামও পেশায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালক। আর ছোটভাই পড়াশোনা করছেন।

সম্প্রতি গোলাপগঞ্জ পৌরসভার ঘোষগাঁওয়ে শহীদ গৌছ উদ্দিনের বাড়িতে আলাপ হয় তার মা লেবু বেগম ও বড় ভাই আবুল কালামের সঙ্গে। জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছরের মাথায় গৌছের স্মৃতিচারণ করেন তারা। শেষ মুহুর্তের স্মৃতিগুলো মনে হলে এখনও কেঁদে ওঠেন মা ও ভাই। 

গৌছের বড় ভাই আবুল কালাম বলেন,  ‘আমার ভাই কোন দলের সাথে যুক্ত ছিল না। কিন্তু ছাত্র আন্দোলন ঢাকা-সিলেট ছাড়িয়ে আমাদের গোলাপগঞ্জ উপজেলায়ও ছড়িয়ে পড়ে, তখন থেকে সে নিয়মিত আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলো।’

তিনি বলেন, ‘আগস্ট সকাল থেকে সে গোলাপগঞ্জ পৌরসভায় আন্দোলনে ছিল। দুপুরে বাড়িতে আসে ভাত খেতে। এ সময় স্থানীয় মাইকে মাইকিং হয় যে ছাত্রদের মেরে ফেলছে পুলিশ, অভিভাবকদের আহবান জানানো হয় দ্রুত সবাই যাতে সদরের দিকে যান। গৌছও তখন বিদায় নিয়ে বের হয়ে যায়। এর কিছুক্ষণ পর শুনতে পাই তার গুলি লেগেছে।’ 

তিনি জানান, ‘ঘটনাস্থল থেকে আমাদের কমবয়সী এক ভাতিজার সাথে গুরুতর আহত গৌছকে অটোরিকশায় তুলে দিয়ে সিলেটের দিকে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আমরা ফোনে যোগাযোগ করে এখান থেকে রওনা হই। তাকে প্রথমে নর্থইস্ট মেডিকেল, পরে সেখান থেকে ওসমানী মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে মৃত ঘোষণা করেন ডাক্তার।’ 

মরদেহ নিয়ে ভোগান্তির স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘গৌছের মৃত্যুর পরের তিনদিন আমাদের জন্য ছিল ৩০ দিনের সমান। ওসমানী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমার ভাইয়ের মরদেহ ফেরত দেয়ার জন্য পুলিশের অনুমতির কথা বলে। আমরা কোতোয়ালী থানায় গেলে সেখানে দুর্ব্যবহারের শিকার হই। পুলিশ বলে আমার ভাইয়ের মতো আমাকেও গুলি করে মেরে ফেলা হবে যদি বেশি কথা বলি। সেদিন রাত ১২টা পর্যন্ত থানা আর হাসপাতালে ঘুরেও ভাইয়ের লাশ নিয়ে ফিরতে পারিনি।’ 

তিনি বলেন, ‘পরদিন (৫ আগস্ট) সকালে গোলাপগঞ্জ থানায় যাই। সেখানে বলা হয় যে যদি আমরা বয়ান দেই যে আমার ভাই গুলিতে নয়, ইটের আঘাতে মারা গেছে, তাহলে তারা ছাড়পত্র দেবে। ভাইয়ের লাশ দাফনের চিন্তা করে আমরা বাধ্য হয়ে বয়ান দিলে গোলাপগঞ্জ থানা আমাদেরকে বলে যে ছাড়পত্র তারা কোতোয়ালীতে পাঠিয়ে দিবে। আমরা সিলেটের কোতোয়ালী যখন আসি ততক্ষণে সরকার পতন হয়ে গেছে, থানা খালি, হাসপাতালেও কেউ নেই। তার পরদিন (৬ আগস্ট) হাসপাতাল থেকে ভাইয়ের লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরি। তখনো কোন পোস্টমর্টেম হয়নি। সেদিন বাদ আসর ফুলবাড়ি বড়মোকাম মাদরাসায় গৌছের জানাজা ও দাফন হয়। আমার ভাইয়ের জানাজায় এত মানুষ হয়েছিলো যা আমরা কল্পনাও করতে পারিনি।’ 

জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে গৌছ উদ্দিন রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদের মর্যাদা পেয়েছেন। দুই দফায় পেয়েছেন ৭ লক্ষ টাকার আর্থিক সহায়তা। তবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জুলাই অভ্যুত্থান শাখা থেকে ঘোষিত ১০ লক্ষ টাকার সঞ্চয়পত্র এখনো পাননি বলে জানান আবুল কালাম।

তিনি বলেন, ‘একবার পৌরসভা আর একবার উপজেলা পরিষদগ। এই দুই জায়গায় অজস্রবার যেতে হয়েছে গত একমাসে। সকল কাগজপত্র একাধিকবার নানা ফরম্যাটে দেয়ার পরেও বারবার আমাদের হেনস্থা করা হচ্ছে। উপজেলায় ৭ শহীদ পরিবারের মধ্যে ৫ পরিবার ইতিমধ্যে পেলেও দুই পরিবার এই ভোগান্তির মধ্যে রয়েছি।’

গৌছ উদ্দিনের হত্যার ঘটনায় ২৩ আগস্ট গোলাপগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন তার ভাতিজা রেজাউল করিম। মামলায় আসামী করা হয় সাবেক সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম না‌হিদ, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মঞ্জুর কাদির শাফি চৌধুরী এলিম, সাবেক পৌরসভা মেয়র আমিনুল ইসলাম রাবেল সহ ১৩৪জনকে। এছাড়াও আরো অজ্ঞাত ২০০/২৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। গৌছ উদ্দিন গুলিতে নিহত হলেও এই মামলায় কোন পুলিশ কিংবা বিজিবি কর্মকর্তাকে আসামী করা হয়নি।

মামলার পরপরই বাদী রেজাউলসহ গৌছের পরিবারের সদস্যরা মামলার বিষয়ে তাদের সম্পৃক্তার বিষয় অস্বীকার করে স্থানীয় গণমাধ্যমে বক্তব্য দেন। রেজাউল দাবি করেন তার স্বাক্ষর জাল করে মামলা দায়ের করা হয়েছে।  

গৌছ হত্যা মামলা নিয়ে রাজনীতি হয়েছে উল্লেখ করে আবুল কালাম বলেন, ‘দাফনের পরেই স্থানীয় কয়েকজন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আমাদের সাথে দেখা করে মামলা করার কথা বললেও আমরা অপারগতা প্রকাশ করি। আসলে আমার বড় ভাইয়ে মৃত্যুর পর তার শোকে আমার বাবা মারা যান। গৌছের মৃত্যুর পর মায়ের শারিরীক অবস্থা খারাপ হয়ে গেলে মায়ের চিকিৎসা ও সুস্থতা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।’ 

গৌছ উদ্দিনের মৃত্যুর একবছরের মাথায়ও ছেলের স্মৃতি তার বয়োবৃদ্ধ মা লেবু বেগমের মনে গভীরভাবে রয়ে গেছে। আজও বাইরে শব্দ শুনলে মনে তার মনে হয় ছেলে বুঝি তার ঘরে কড়া নাড়বে।

ছেলের স্মৃতি রোমন্থন করে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ’সময়ে সময়ে ভিতরে তাকি জ্বালা যায় না, খালি বুঝা যায় বুকো ধড়ফড় ধড়ফড় করে, এই জ্বালা লইয়া কিলা ঘুমাইতামরে বাবা। যাওয়ার সময় কইছিলাম তুমি দেশর লাগি শহীদ অইযিবায়, মারে সারাজীবন জ্বালাত রাখিয়া। এই জ্বালা যার না, একবার খাইতে পাররাম, আরেকবার পাররাম না, পানি দিয়া গিলিয়ার।’ 

আজকের সিলেট/ডি/এসটি

সিলেটজুড়ে


মহানগর