
রাজনীতিতে নিজেদের ন্যারেটিভ প্রচার করতে না পারায় বিএনপি সঙ্কটে পড়ছে বলে মনে করছেন রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া সিদ্ধান্তের দীর্ঘসূত্রিতা, নেতৃত্বে চেইন অব কমান্ডের স্ট্রাকচার না থাকা, দলের নির্দিষ্ট একক কৌশল প্রণয়ণে সিদ্ধান্তহীনতা, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রার্থী নির্ধারণে দোদুল্যমানতা ও দলটির বিরুদ্ধে ব্যাপক সংঘবদ্ধ নেতিবাচক প্রচারণা তরুণদের মাঝে দলটির ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
এছাড়াও ভারতপন্থী ট্যাগও দলটির চিয়ারত রাজনৈতিক ইমেজকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করছে বলে করছেন বিশ্লেষকরা।
অন্যদিকে বিএনপির নেতাদেরও অনেকে মনে করছেন, বিএনপি দলটিই নিজেই একটি ন্যারেটিভ। দলের নামের মধ্যেই রয়েছে এই সহজাত শক্তিশালী বয়ান। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, সবার আগে বাংলাদেশ, উদার ধর্মীয় স্বাধীনতা, সকল-মত-পথ, ধর্ম -বর্ণে একক বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের চেয়ে তো আর বড় ন্যারেটিভ এখন হতে পারে না। আমাদের এখন যে শুধু ন্যারেটিভের ব্যাপক ব্রান্ডিং করার সঙ্কট তা নয়, জনগণের মাঝে গত দেড় বছরে বিএনপি মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার হয়েছে।
এছাড়া দলটিকে নিয়ে জনমনে ব্যাপক ইতিবাচক প্রত্যাশা যা এখনও বিদ্যামান। কিন্তু জেলা-উপজেলায় দলের একটি অংশের নেতিবাচক কাজকর্মে জনমনে দলটির একাংশ সম্পর্কে আস্থার সঙ্কটও সৃষ্টি করেছে। কেননা, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগে দল থেকে যাদের বহিষ্কার করা হয়, ঐ নির্বাচনই এলাকাতেই বিএনপির অন্যগ্রুপ তাদেরকে নিয়েই আবার দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করে। এতে বহিষ্কার শুধু কাগজে পরিনত হয় আর নির্বিঘ্নে চলে বহিষ্কৃতদের দলখদারি ও চাঁদাবাজি।
বিএনপির একাধিক নেতা এই ইসু্যতে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তারেক রহমানের বেশিরভাগ সিদ্ধান্তই এখন বাস্তবায়ন হয় না। বহিষ্কৃতদের সাথে যারা সম্পর্ক রাখবে যদি তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর অবস্থান নেওয়া যেত তাহলে মানুষের মাঝে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হতো। যদি চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া যেত তাহলে আরো ভালো হতো। তারেক রহমান বার বার পরিবর্তনের কথা বলছেন কিন্তু সেই পরিবর্তন বিএনপি দৃশ্যমান করতে পারছে না। যার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মন্দের ভালো হিসেবে অন্যরা সুযোগ নিচ্ছে। আর বিএনপির বিরুদ্ধে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র তো আছেই।
রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, সূফীবাদী ইসলামী মূল্যবোধ, ভারতীয় আধিপত্যবাদ বিরোধী ন্যারেটিভের চেয়ে শক্তিশালী ন্যারেটিভ আর নেই। বিএনপির জন্ম ও জনপ্রিয়তা অর্জনের ভিত্তিও ছিল এসব। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ভারতপন্থীদের বিরুদ্ধে বিপ্লবের মাধ্যমে ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমানের উত্থান। সেখান থেকেই সারাদেশের ইসলামী মূল্যবোধ, দেশপ্রেমিক বাম ও উদারপন্থী মানুষের মিলনস্থল ছিল বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ধারক বিএনপি।
কিন্তু এসব প্রচার, প্রসার ও তরুণ প্রজন্মের কাছে যথাযথভাবে তুলে ধরতে বিএনপির শক্তিশালী উইং নেই। যার কারণে জেন-জি সহ তরুণ প্রজন্মের কাছে জামাত ও অন্যান্য দলগুলো সেই সুযোগ নিচ্ছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন বেপারি বলেন, বিএনপি নিজেই একটি ন্যারেটিভ ছিল। জিয়াউর রহমানের সততা, ভারতের আধিপত্যবাদ বিরোধী রাজনীতি বিএনপি ধরে রাখলে এবং তা ব্যাপকভাবে প্রচার ও প্রসারের মাধ্যমে বিএনপির ন্যারিটেভ শক্তিশালী করা সম্ভব।
প্রবীণ এ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, ডাকসু ও জাকসুতে যাই হোক। জাতীয় পর্যায়ে বিএনপি শক্তিশালী দল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ১৫ বছর ছাত্রদলকে স্বাভাবিক কার্যক্রম করতে দেওয়া হয়নি। আওয়ামী লীগ মনে করতো তাদের চ্যালেঞ্জ ছাত্রদল। এজন্য হলগুলোতে ছাত্রদলকে থাকতে দেওয়া হয়নি। যার কারণে শিক্ষার্থীদের সাথে ছাত্রদলের মেশারও সুযোগ ঘটেনি । অন্যদিকে শিবির সাধারন ছাত্র হয়ে, ওদের সাথে মিশেছে।
ড. বেপারি বলেন, ৫ আগস্টের গণঅভু্যত্থানে জামায়াত-শিবিরের শক্তিশালী ভূমিকা ছিল এটা সত্যি। সমন্বয়কদের বড় অংশও শিবিরের ছিল। কিন্তু বিএনপি ও ছাত্রদলের বিপুল সংখ্যক নেতা-কর্মীর এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ ও শহীদ হয়েছে। ছাত্রদলের সেই অংশগ্রহণকেও তারা সুন্দরভাবে প্রচার করতে পারেনি। এই ব্যর্থতা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিবিরকে লাইমলাইটে এনেছে। ছাত্রদলকে ব্যাকফুটে নিয়েছে।
ড. বেপারি আরো বলেন, এই আন্দোলন ছিল আধিপত্যবাদ বিরোধী আন্দোলন। সাধারণ ছাত্ররা এখনও ভারত বিরোধী। এটা মাথায় রাখতে হবে। বিএনপি ও ছাত্রদলের দোদুল্যমান অবস্থান রাজনীতিতে জামায়াত-শিবিরকে সুযোগ দিয়েছে। ছাত্রদল ও বিএনপি ভারতপন্থী কি না এমন- কনফিউশন সাধারণ মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে। এসবের কারণে শিবিরকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা অভু্যত্থানের মূল ভাবতে শুরু করেছে।
ড. নুরুল আমিন আরো বলেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্কট, অভাব, অনটন নিরসনে জামায়াত-শিবির ব্যাপক ফান্ডিং করেছে। তাদের কাছে টাকা সমস্যা না। কিন্তু বিএনপির এমন কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নেই। অথচ ছাত্রদল ও বিএনপিকে জিয়াউর রহমানের শূন্য থেকে শক্তিশালী করেছিলেন।
বিএনপিকে পরমর্শ দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক এ চেয়ারম্যান আরো বলেন, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান যদি ক্ষমতায় আসতে চান তাহলে তাদের এসব মাথায় রাখতে হবে। বিএনপি যতোটা না লুটপাট করেছে, তার চেয়ে বেশি তাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার হচ্ছে। কারা করছে, এগুলো খুঁজে বের করে তাদের অপপ্রচারের জবাব দিতে হবে। বিএনপি সবসময় দোদুল্যমান। হাসিনা পতনের সময়ও দোদুল্যমান ছিল বিএনপি। বিভিন্ন বিষয়ে জামায়াত কিন্তু দোদলুম্যান ছিল না, এখনও নেই। তাই বিএনপিকে দোদুল্যমানতাও পরিহার করে কঠোর হতে হবে। জিয়ার পথ অবলম্বন করতে হবে। রাজনীতিতে মেধাভিত্তিক সৃষ্টিশীল নেতৃত্ব তৈরী করতে হবে, সেভাবে হিলফুল ফুুযুল করে জিয়াউর রহমান নেতৃত্ব তৈরী করতেন। আর ভারতের আধিপত্যবাদ বিরোধী মনোভাব রাখতে হবে। তাহলে দল টিকবে। কেননা, এই মনোভাবই বিএনপির মূলভিত্তি।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, "ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে নানা ধরনের কারচুপির খবর শোনা গেছে। এসব ফলাফল ছাত্রদলের ফেভারে না যাওয়া মানেই বিএনপি অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে, এমন ভাবার কোনো কারণ দেখছি না। বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক রাজনীতি এবং জাতীয় রাজনীতি- দুটো আলাদা বিষয়। তবে এই পরাজয় একটা প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে, যার মাধ্যমে আমরা আমাদের প্রচার, সমন্বয় এবং ছাত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করতে পারি। ইতোমধ্যেই আমরা বিভিন্ন দিক থেকে বিশ্লেষণ শুরু করেছি, যাতে ভুল-ত্রুটি শুধরে ভবিষ্যতে আরও কার্যকর ও দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া যায়।
আজকের সিলেট/ডি/এসটি
