ডিসি-ইউএনও বদলি হলেও 'বহাল তবিয়তে' এসপি-ওসি
শনিবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৫, ১২:৫১ AM

ডিসি-ইউএনও বদলি হলেও 'বহাল তবিয়তে' এসপি-ওসি

বিশেষ প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২১/০৮/২০২৫ ১০:৩১:১০ AM

ডিসি-ইউএনও বদলি হলেও 'বহাল তবিয়তে' এসপি-ওসি


সাদাপাথরকাণ্ডে সিলেটের প্রশাসনে আংশিক রদবদল হয়েছে। এর অংশ হিসেবে সিলেটের জেলা প্রশাসক (ডিসি) শের মাহবুব মুরাদ ও জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আজিজুন্নাহারকে বদলি করা হয়েছে। তবে পুলিশের প্রত্যক্ষ মদদে পাথর লুটপাট হলেও এখনো রহস্যজনক কারণে বহাল তবিয়তে রয়েছেন বহুল আলোচিত ও সমালোচিত কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি উজায়ের আল মাহমুদ আদনান ও সিলেটের পুলিশ সুপার (এসপি) মো. মাহবুবুর রহমান স্বপদে বহাল রয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন ও মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।

উপজেলার ভোলাগঞ্জ, সাদাপাথর, রোপওয়ে, ধলাই নদীসহ আশপাশের এলাকায় বালু ও পাথর উত্তোলনের ওপর সরকারের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা কার্যত মানা হয়নি। দিনরাত চলে অবৈধ বালু-পাথর উত্তোলন ও পাচার। এতে সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব। আর এর একটি বড় অংশ চলে যেত ওসি ও এসপির কাছে। সাম্প্রতিক সময়ে দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনেও এমন তথ্য উঠে এসেছে।

অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় গড়ে উঠেছে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। এদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের কোনো কার্যকর ব্যবস্থা দেখা যাচ্ছে না, যা নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে।

দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান সম্পর্কে বলা হয়েছে, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ২৭ এপ্রিল অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন ও পরিবহণ বন্ধের জন্য পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দিলেও সিলেট জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান আলোচ্য সাদা পাথর লুটপাটের বিষয়ে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। 

একই প্রতিবেদনে কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি উজায়ের আল মাহমুদ আদনান সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনিসহ সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ সদস্যরা অবৈধ পাথর ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিভিন্ন অঙ্কের কমিশন গ্রহণ করে সাদা পাথর লুটপাটে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেছেন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অবৈধভাবে উত্তোলিত পাথর প্রতি ট্রাকে প্রায় ৫০০ ঘনফুট করে লোড করা হয়। পরিবহণ ভাড়া ছাড়া প্রতি ট্রাকের পাথরের দাম ধরা হয় ৯১ হাজার টাকা। এর মধ্যে প্রতি ট্রাক থেকে দশ হাজার টাকা পুলিশ ও প্রশাসনের জন্য আলাদা করা হয়। বাকি ৮১ হাজার টাকা অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনকারীরা নিজেদের মাঝে বণ্টন করে নেয়। এছাড়া প্রতি ট্রাক থেকে ১০ হাজার টাকার মধ্যে পুলিশের জন্য ৫ হাজার টাকা এবং উপজেলা প্রশাসনের জন্য ৫ হাজার টাকা বণ্টন হতো। এছাড়াও অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন কাজে ব্যবহৃত প্রতিটি বারকি নৌকা হতে এক হাজার টাকা করে নেওয়া হয়। যার মধ্যে পুলিশ বিভাগ পায় ৫০০ টাকা এবং প্রশাসন পায় ৫০০ টাকা। পুলিশ নির্দিষ্ট সোর্সের মাধ্যমে প্রত্যেক ট্রাক ও নৌকা থেকে এসব চাঁদা বা অবৈধ অর্থ সংগ্রহ করে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ওসি এসব চাঁদার টাকা সমাহারে নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নিতেন। আর এর বড় একটি অংশ যেত এসপির কাছে। যেকারনে এতো অভিযোগের পরও এসপির শেল্টারে বেপরোয়া হয়ে উঠেন ওসি। সূত্র থেকে আরো জানা যায় কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি উজায়ের আল মাহমুদ আদনান এসপি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী ছিলেন। তাই নিজের সহপাঠীকে সেনাপতি বানিয়ে নেন। ফলে এসপির কাছে ওসির এমন অপকর্মের প্রতিকার চাওয়া হলে ওসিকে শাস্তির আওতায় না এনে উল্টো অভিযোগকারিকে হেনস্তা করতেন এসপি।

এদিকে, ডিসি ও ইউএনও’র বদলিকে অনেকে দেখছেন একটি কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবে। কারণ, তারা প্রশাসনের সিভিল অংশের প্রতিনিধিত্ব করেন। আর সিভিল প্রশাসনের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।  আর যেই পুলিশ কর্মকর্তারা পাথর লুটপাট বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা এবং নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেনি তাদেরকেই বহাল তবিয়তে রাখা হয়েছে।

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলী আকবর বলেছেন, আমরা প্রতিনিয়ত প্রশাসন ওসি ইউএনও কে এই লুটপাটের বিষয় অবগত করছি কিন্তু তাদের কোনো সারা পাইনি। ৫ আগষ্টের পর পরই সাদাপাথর ধোলাই নদীর বিষয়ে ওসির কাছে বার বার বলেছি। ওসি বলছেন আমাকে ডিসি স্যার এখন ও কিছু জানায় নি, ইউএনও এর কাছে গেলে উনি বলেন ওসি কে বলে দিছি। কিন্তু তারা কেউই এই বিষয়ে গুরুত্ব দেয় নি। 

তিনি বলেন, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির নেতৃবৃন্দদের নিয়ে আমরা অনেক বৈঠক করেছি, আমাদের দলের বদনাম বের করা হচ্ছে। আমাদের দলের নেতারা বরং এই সাদাপাথর গুলা বাঁচাতে পারি এই চিন্তা নিয়ে সব সময় কথা বলছি।

সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ, হতাশা ও নিরাপত্তাহীনতা দেখা দিয়েছে। তারা বলছেন, কোম্পানীগঞ্জে শুধু পাথর লুট হচ্ছে না। এই উপজেলার সীমান্ত দিয়ে অবাধে চেরাচালান আসছে। কিন্তু পুলিশ কোন কার্যকর প্রদক্ষেপ নেয়নি। 

ডিসি ও ইউএনও বদলির মাধ্যমে প্রশাসন পরিবর্তনের চিত্র দেখালেও প্রকৃত অপরাধ দমন ও সুশাসনের প্রশ্নে এখনও অন্ধকারে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ। ওসি ও এসপি বহাল থাকার বিষয়টি জনমনে যেমন প্রশ্ন তৈরি করছে, তেমনি প্রশাসনের প্রকৃত সদিচ্ছা নিয়েও সংশয় জাগছে।

আজকের সিলেট/এপি/এসটি

সিলেটজুড়ে


মহানগর