ভূমিকম্পের ‘ডেঞ্জার জোন’ সিলেট
মঙ্গলবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৭:১৮ PM

ভূমিকম্পের ‘ডেঞ্জার জোন’ সিলেট

বিশেষ প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৫/০৯/২০২৫ ১২:০০:০৭ PM

ভূমিকম্পের ‘ডেঞ্জার জোন’ সিলেট


সিলেট শহর মাত্র দু'শ কিলোমিটার দূরেই ডাউকি ফল্টের অবস্থান। সক্রিয় এ ফল্টের কারণে বিভিন্ন সময়ে ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে ঐ এলাকা। আর এই শহরে রয়েছে প্রায় ৪২ হাজার বহুতল ভবন। ডাউকি ফল্টে মাত্র সাত মাত্রার ভূমিকম্প হলেই সিলেট শহরের ৪২ হাজার বহুতল ভবনের ৮০ শতাংশই ধসে পড়বে, এমন শঙ্কার কথাই জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সবশেষ রোববার বিকেলে আবারও ভূমিকম্পে কেঁপে উঠে সিলেট। এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেটের নিকটবর্তী ভারতের আসামে। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৯। প্রতিবার ভূমিকম্প হলেই আতঙ্কের বিষয়টি সামনে আসে আর কিছু দিন আলোচনার পর তা আবারো মানুষজন ভূলে যান। 

সিলেট আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, এই ভূমিকম্পটির উৎপত্তি সিলেটের কানাইঘাট সীমান্তে। সিলেটের ডাউকি চ্যুতি থেকে এই ভ’মিকম্পের সৃষ্টি। গত কয়েক বছরে এই চ্যুতিরেখায় বেশ কয়েকটি ভূমিকম্প হওয়ায় বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। আসামের এই ভূমিকম্প সিলেটের জন্য সতর্কবার্তা বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এদিকে, বিশেষজ্ঞরা সিলেট অঞ্চলটিকে ভূমিকম্পের ডেঞ্জারজোন হিসেবে বারবার সতর্ক করা হলেও থামছে না অপরিকল্পিত নগরায়ন। তবে সম্প্রতি তুরস্ক ও সিরিয়ার ভয়াবহ ভূমিকম্পের ঘটনায় আতঙ্ক বেড়েছে স্থানীয় মানুষের মনে। বিল্ডিং কোড না মেনে ভবন নির্মাণ, জলাধার ভরাট, অপরিকল্পিত নগরায়ন এ আতঙ্ক আরো বাড়াচ্ছে। 

ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমাতে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে উপরের পানির ব্যবহার বাড়ানো, বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মানসহ নানা পরামর্শ দিয়েছেন ভূত্বত্ত্ববিদরা। ভূমিকম্প এমন একটি দুর্যোগ যার আগাম পূর্বাভাষ দেয়া যায় না, তাই ভূমিকম্প হলে যাতে জীবনহানি ও ক্ষয়ক্ষতি কম হয় সে লক্ষ্যে নিয়মত প্রশিক্ষণ ও মহড়া চালানোর পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।

আবহাওয়াবীদরা জানান, টেকটোনিক প্লেটের কিনারে অবস্থান করায় সিলেটে ভূমিকম্পের ঝুঁকিও বেশি। ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে প্রাক প্রস্তুতি নেয়ার পরামর্শ তারা।

জানা যায়, বাংলাদেশের সিলেট ও ভারতের আসাম মিলিয়ে ডাউকি চ্যুতি পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় তিন শ কিলোমিটার বিস্তৃত। ১৮৯৭ সালে ‘ডাউকি ফল্টে’ ৮ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। যাতে ভেঙে পড়ে এই অঞ্চলের বেশিরভাগ বহুতল ভবন। প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেটে দিনদিন বাড়ছে আকাশছোঁয়া ভবন তৈরির প্রতিযোগিতা। ভরাট হচ্ছে জলাধার। কেটে ফেলা হচ্ছে পাহাড় টিলা। এতে বাড়ছে ভ’মিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কাও।

গবেষকদের মতে, সিলেটের অধিকাংশ বাণিজ্যিক ভবনই অপরিকল্পিত এবং ঝুঁকিপূর্ণ। রিখটার স্কেলে সাত বা তার চেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে অধিকাংশ ভবনই ভেঙ্গে পড়বে।

গবেষকরা জানিয়েছেন, অপরিকল্পিত বাসাবাড়ি নির্মাণের কারণে সবচেয়ে বেশী ক্ষতির সম্মুখীন হবে নগরীর শাহজালাল উপশহর, আখালিয়া, বাগবাড়ি, মদিনা মাকের্ট প্রভৃতি এলাকা। বাণিজ্যিক ভবন ও ইমারতের পাশাপাশি নগরীতে অপরিকল্পিত ও ঝুঁকিপূর্ণ অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। গবেষণার তথ্য মতে, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বহু বেসরকারী হাসপাতাল রয়েছে যেগুলো ভূমিকম্পের সময় ধসে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। আর এসব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ধসে পড়লে প্রাণহানি আরো বেড়ে যাবে।

কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ, জাপান ও শ্রীলংকার একটি বিশেষজ্ঞ টিম সিলেট নগরীর ৬ হাজার ভবনের উপর জরিপ চালিয়ে এই গবেষণা রিপোর্ট তৈরি করেন। এই গবেষণা দলে ছিলেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুর ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম।

ড. জহির বিন আলম বলেন, ভূমিকম্পের দিক থেকে সিলেট মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে থাকলেও তাৎক্ষণিক ক্ষতি-হ্রাস ও উদ্ধার কাজ চালানোর জন্য সিলেটে আধুনিক কোন যন্ত্রপাতি নেই। তিনি ভূমিকম্পের ঝুঁকি মাথায় রেখে এখনই প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহবান জানান। সিলেটের ৭৪.৪ শতাংশ ভবনই ভূমিকম্পের কথা চিন্তা না করে তৈরি করা হয়েছে। এগুলো ভূমিকম্প প্রতিরোধক ভাবে নির্মান করা হয়নি। ফলে সাত মাত্রার ভূমকম্প হলেই ৮০ শতাংশ বহুতল ভবন ভেঙ্গে পড়তে পারে।

তিনি বলেন, ভিন্ন ভিন্ন স্থান থেকে ঘনঘন ভূমিকম্পের উৎপত্তি হলে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। তবে যদি একই জায়গা থেকে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয় তাহলে অব্যশই চিন্তার বিষয়। এরকম ঘনঘন ভূমিকম্প হলে আমাদের একটু সর্তক থাকতে হবে।

ভূমিকম্প বিষয়ক বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে জানা যায়, ভূমিকম্পের মাত্রা অনুসারে বাংলাদেশ তিনটি ভূ-কম্পন বলয়ে বিভক্ত। এর মধ্যে এক নম্বর বলয়ে রিখটার স্কেলে ৭ থেকে ৯ বা তার অধিক মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। আর এই এক নম্বর বলয়েই সিলেটের অবস্থান। এই বলয়ে আরও রয়েছে ময়মনসিংহ ও রংপুর।

সিলেট সিটি করপোরেশনের বর্তমান আয়তন ৭৯.৫ কিলোমিটার। ২০২১ সালে সীমানা বর্ধিত করার পূর্ব পর্যন্ত আয়তন ছিল  ২৬.৫ বর্গকিলোমিটার। পূর্বের আয়তনের তালিকাভূক্ত হোল্ডিংয়ের সংখ্যা প্রায় ৭৪ হাজার। এর মধ্যে দুই থেকে ২১ তলা পর্যন্ত ভবন রয়েছে ৪১ হাজার ৯৯৫টি। সীমানা বাড়ানোর পর ভবনের সংখ্যা আর জরিপ করা হয়নি।

আজকের সিলেট/ডি/এসটি

সিলেটজুড়ে


মহানগর