শব্দের দোলায় দোলে ওঠে আনন্দ-বেদনা, সুখ আর শোকের সময়
রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০৭:০৪

স্মৃতির বাঁকে খুঁজি মাকে

শব্দের দোলায় দোলে ওঠে আনন্দ-বেদনা, সুখ আর শোকের সময়

মিজান মোহাম্মদ

প্রকাশিত: ০৪/০১/২০২৪ ১১:৩৪:৪৭

শব্দের দোলায় দোলে ওঠে আনন্দ-বেদনা, সুখ আর শোকের সময়

স্মৃতির বাঁকে খুঁজি মাকে গ্রন্থের প্রচ্ছদ


বাংলা সাহিত্যের শাখাগুলোর মধ্যে ছড়া হলো প্রাচীন ও আদি শাখা। ছন্দ, অন্তমিল, অন্তরমিলের বদৌলতে ছড়া হয়ে উঠেছে জনসাধারণের প্রিয় শাখা, প্রিয় পাঠ্য । দিন যত যাচ্ছে ছড়া লেখক-পাঠক সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। আর এই গ্রহণযোগ্যতার মূল কারণ হলো ছড়া চরিত্রের বাঁকবদল।
মা খালারা সেই আদিকাল থেকে ঘুমপাড়ানোর জন্য ছড়া শোনাতেন, আজও শোনান। তবে ছড়া শুধু যে ঘুম পাড়াচ্ছে তা নয়, ছড়া এখন ঘুম তাড়াচ্ছেও। ঘুমপাড়ানি থেকে শুরু করে ঘুমতাড়ানি পর্যন্ত ছড়া চরিত্রের যে বাঁক তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- সমাজ সংসারের বিভিন্ন অনিয়মকে নিয়ে লেখা, দেশ ও দশকে নিয়ে লেখা, অদৃশ্য গভীর ঘুম থেকে জাতিকে জাগিয়ে তোলা, জাত-ধর্ম ও বর্ণের উর্দ্ধে ওঠে আমাদের বিবেককে জাগিয়ে তোলে আমাদের মানুষ করে তুলতে ছড়া মন্ত্র হিসেবে কাজ করে। ছড়া কাজ করছে দেশ মাটি ও মানুষকে নিয়ে। ছড়া হচ্ছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে, মা-বাবাকে নিয়ে, ছড়া হচ্ছে প্রিয়জনের জন্য ।

আশির দশকের তুখোড় ছড়াকার অজিত রায় ভজন'র এমনই এক ছড়াগ্রন্থ ‘স্মৃতির বাঁকে খুঁজি মাকে’। এটি লেখকের দ্বিতীয় একক গ্রন্থ। গ্রন্থটির প্রতিটি পাতায় পাতায় শব্দে শব্দে ফুটে ওঠেছে মায়ের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা- ভালোবাসা, হৃদয় নিংড়ানো আবেগ-অনুভূতি । শুধুমাত্র মাকে নিয়ে লেখা ৪০টি ছড়া দিয়ে সাজানো গ্রন্থটি অবশ্যই ভিন্নতার দাবী রাখে।

হিন্দু সমাজে কোন মা যখন বিধবা হয়, তখন সে তাঁর নিজ সন্তানের শুভ কাজে অংশ গ্রহণ করতে পারেন না। এমনকি বিধবা মাকে এমন সব অনুষ্টানে মনে করা হয় অস্পৃশ্য । ছড়াকার এ নিয়মকে বুড়ি আঙ্গুল দেখিয়ে গ্রন্থটির প্রথম ফ্লাপেই লিখেছেন-
যে শুভ কাজে স্নেহময়ী জননী নেই
এমন শুভ কাজে ! নাইবা গেলাম।
---বৈধব্য ও অস্পৃশ্যতা (গ্রন্থটির প্রথম ফ্লাপ)

মায়ের আদর স্নেহ ও আলিঙ্গনের সাথে পৃথিবীর আর কারো সাথে তুলনা করা হয়না। কোন সন্তানই ভুলতে পারেনা তার মায়ের আদর স্নেহ ও আলিঙ্গনের কথা। ‘মা হল পৃথিবীর একমাত্র ব্যাংক, যেখানে আমরা আমাদের সব দুঃখ, কষ্ট জমা রাখি এবং বিনিময়ে নেই বিনাসূদে অকৃত্রিম ভালোবাসা’– জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ'র সুরে সুরে সাথে তাল মিলিয়ে ছড়াকার লিখেছেন-
আঁচল দিয়ে মুছে দিতো
আমার মুখো খানি
দুঃখ সবই হারিয়ে যেতো
তখন দূরে জানি।
তাঁরই কোলে মাথা রেখে
আবার দিয়ে ঘুম
--মায়ের সেরা ওম।
---(ছড়া- আসতো যদি মা, পৃষ্টা-৯)

ছড়া শুনিয়ে শুনিয়ে ছোটবেলায় মায়ের ঘুমপাড়ানির কথা লেখক এখনো ভুলতে পারেননি । খোঁজে বেড়ান সেই সব মাসী-পিসিদের যারা মায়ের ডাকে এসে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে যেতেন। তাইতো লেখক মনের শুন্যতা কন্ঠে এনে বলেন-
ঘুম পাড়ানি মাসী-পিসি
তোমরা সবে কই?
আমার সোনা ঘুমায় নাতো
জলদি এসো সই।
--
মাগো তোমার সেই সখি-রা
আরতো আসে না,
তোমায় ছাড়া কেউ তো আমায়
ভালোই বাসে না।
---(ছড়া- ঘুম পাড়ানি, পৃষ্টা-১০)

গর্ভ থেকে সন্তান বড় করা পর্যন্ত মা যে কী পরিমাণ অসহনীয় কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করেন তা একমাত্র মা ব্যতীত অন্য কারো পক্ষে উপলব্দি করা সম্ভব নয়। তারপরও আমরা মা কে দেই কি তার প্রাপ্য সম্মান ?
যার মা আছে, সে কখনও গরীব নয়- আব্রাহাম লিংকন'র এই উক্তি ভুলে সম্পর্কের টানাপোড়নের কঠিন সময়ে আমরা প্রতিনিয়ত নানাভাবে জন্মদাতা পিতা-মাতার প্রতি প্রদর্শন করে যাচ্ছি অন্যায়-অবহেলা। পশুর চোখ নিয়ে বাস করা আমাদের অন্তর আত্মাকে জাগিয়ে তুলতে ছড়াকার লিখেছেন-
জঠর যাতনা,/সহেছো মা গো/ মাগো
তোমার বুকে/ থেকেছি সুখে/ নাগো?
দুখের রাতি/ করেছো সাথী, তুমি
চরণ তবু/ আমরা কভূ/ চুমি?
---(ছড়া- মা, পৃষ্টা-১২)

শারদীয় দুর্গা উৎসব, মা দুর্গার আগমন অন্য সবার মতো লেখক মনকেও রাঙিয়ে দিয়ে যায়। শঙ্খ, ঢোলক, করতালের শব্দে কাশবনে ঢেউ লাগা, লেখক মনে আলোর নাচন খেলে যায়। তখন লেখক খুঁজে পান মমতাময়ী মায়ের গন্ধ-ছায়া।
রঙ লেগেছ নীল আকাশে
সবুজ হলো বন,
মা এলো তাই আনন্দেতে
অবুঝ হলো মন।
খুশির জোয়ার বইলো যে রে
শারদ ভোরে আজ,
তাইতো দেখি নতুন করে
ভুবন জুড়ে সাজ।
---(ছড়া- মা এলো, পৃষ্টা-১৫)

মা ইহজগতে নেই এই বাস্তবতাটি লেখক এখনো মেনে নিতে পারেন নি। আত্মজা, ভাগ্নি, মা দুর্গা এমনকি শীতসকালের শিশির বিন্দুতে ও মায়ের ছবি তাঁর মানসপঠে ভেসে ওঠে। আর তিনি লিখেন-
মাগো তুমি আমার আকাশ
সাদা মেঘের ভেলা,
রাঙা ভোরে প্রথম রোদে
মিষ্টি মধুর খেলা।
শীত সকালে শিউলী তলে
শিশির ভেজা ঘাসে,
আনমনে মা তাকিয়ে দেখি
তোমার ছবি ভাসে।
---(ছড়া- ভালোবাসি মাকে, পৃষ্টা-১৭)

বৈশাখি ঝড়, ঝড়ের রাত, শীতের রাতে মায়ের পরম বিশ্বস্ত বুকে, স্নেহ পরশের স্মৃতি সর্বদা তাড়িয়ে বেড়ায়। তাইতো লেখক মায়ের চিতায় আগুন দিতে গিয়ে বার বার কেঁপে ওঠেছেন, কেঁপে ওঠেছে তার বুক। মা হীন জীবনটাকে মনে হচ্ছে একটা শ্মশান ।
যে মুখ দিয়ে আমায় চুমু
দিতো দিবস যামী,
কেমনে মাগো সেই মুখেতে
আগুন দেবো আমি।
কত্ত নিঠুর হয়ে গো মা
সাজাই তোমার চিতা
দুঃখ হয়ে কান্না যে আজ
আমার হলো মিতা।
---(ছড়া- মা’য়ের চিতা, পৃষ্টা-২৪)

আমাদের সমাজে এমন অনেক মানুষ আছে যারা মেয়েকে নিজেদের বোঝা মনে করেন, মনে করেন মেয়ে দায়ের পাল্লা ভারী করতে জন্ম নিয়েছে। কিন্তু লেখক মেয়ের জন্মকে নিজের নতুন ভোর মনে করেন, মনে করেন সৌভাগ্যের প্রতীক। লেখককের উপলব্দি হলো মেয়ে বাবার না পাশে থাকলে চন্দ্রতারা হাসে না। সেই উপলব্দি থেকে লিখেন-
বাবার কিছু থাক বা না থাক
তুইতো আছিস মা’রে,
তুই যে আমার রাজকন্যা
বলছি বারে-বারে।
আজকে যতো আলো আছে
সব যে দেওয়া তোর,
তোর কারণেই স্বপ্ন নিয়ে
আসে নতুন ভোর।
---(ছড়া- বাবা আর মেয়ে, পৃষ্টা-৩০)

আঁধার রাত লেখকের মনে ভয় ধরিয়ে দেয়। মায়ের অন্ধকার কবরের কথা মনে করিয়ে দেয়। লেখক মায়ের কবরের পাশে মোমবাতি জ্বালিয়ে আসেন। লেখক মাকে মনে করেন জ্যান্ত দুর্গা । তাই ঘরের জ্যান্ত দুর্গাকে দূরে রেখে , অবহেলা করে মাটির কালী দুর্গাকে মিটাই-মন্ড দিয়ে সুখে থাকতে নিষেধ করেছেন। লেখক ভাবতে বাধ্য করে লিখেন-
জ্যান্ত কালী দুর্গা মাহে
তুই যে রেখে ঘরে,
মাটির মাকে পূজা করিস
কত্ত যতন করে।
নাড়ী ছেড়া তুই যে মানিক
মা’য়ের কথা ভাব রে খানিক।
---(ছড়া- জ্যান্ত দুর্গা, পৃষ্টা-৪৭)

‘ছড়া শুধু ছোটদের বিষয়- এই কথাটি যারা বলেন, আমি মনে করি তারা বয়সের ধুঁয়ো তুলে ছড়াকে ছোট্ট গণ্ডির চার দেয়ালে বন্দি করতে চাইছেন। সাহিত্যের বিশাল ভাণ্ডার ছড়াকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ ছড়ার সম্প্রসারিত রূপই হচ্ছে কবিতা। আমি মনে করি, ছড়া শুধু ছোটদের নয়, ছড়া বড়দের নয়, ছড়া আসলে পাঠকের।' -বিশিষ্ট ছড়াকার আনজীর লিটন'র এই উক্তিকে প্রমাণ করার জন্য ছড়াকার অজিত রায় ভজনের ‘স্মৃতির বাঁকে খুঁজি মাকে’ গ্রন্থটি সর্ব সেরা রেফারেন্স হতে পারে। গ্রন্থটি হতে পারে ছোট বড় সবার সুপাঠ্য, সুখপাঠ্য।

ধ্রুব এষের নান্দনিক প্রচ্ছদে সপ্তডিঙা থেকে প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের প্রাচীনতম ছড়া সংগঠন ছড়া পরিষদের সহ-সভাপতি ছড়াকার অজিত রায় ভজনের ‘স্মৃতির বাঁকে খুঁজি মাকে’ গ্রন্থটি অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৯ কে ঘিরে। আদরের দুই সন্তান কন্যরূপী মা দূর্বা ও ছেলেরূপী বাবা অর্ঘ্যকে গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে।
৩ ফর্মার গ্রন্থটির মূল্য রাখা হয়েছে ১৩৫ টাকা। বইটির টেকসই বাঁধাই ও পরিচ্ছন্ন ছাপা আমাদের বইটি হাতে নিতে প্রলুব্দ করবে। তবে বইটির মুদ্রণ প্রমাদ ও কাগজের মান দৃষ্টিকটু।

একটি ছড়ায় জীবন-দর্শন থাকতে হবে। দেশ-মাটি-প্রকৃতি আর মানুষকে ভালোবাসার কথা থাকতে হবে। সেই সঙ্গে ছড়ায় নির্মল আনন্দ-বিনোদনেরও প্রয়োজন রয়েছে। সময় এবং সমাজকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে এমন বিষয়ও ছড়ায় থাকা প্রয়োজন। তাহলেই ছড়া হয়ে উঠে পাঠকপ্রিয়। শিশুসাহিত্য হয়ে উঠে বর্ণাঢ্য। যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ ‘স্মৃতির বাঁকে খুঁজি মাকে’।

আজকের সিলেট/মিজান

সিলেটজুড়ে


মহানগর